রেলে বিপুল বিনিয়োগ তবুও থামছে না মৃত্যুর মিছিল

Passenger Voice    |    ০৪:৩৯ পিএম, ২০২০-১২-২১


রেলে বিপুল বিনিয়োগ তবুও থামছে না মৃত্যুর মিছিল

স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশে রেলপথ ছিল ২৮৫৮ কিলোমিটার। গত বছরে বেড়েছে ২০০ কিলোমিটার। বর্তমানে মোট রেলপথের সংখ্যা ৩০১৮ কিলোমিটার। এই ৩০০০ কিলোমিটার রেলপথে যেন প্রতি মিটারে একটা করে লেভেল ক্রসিং রয়েছে৷ ঘন ঘন ক্রসিংসের কারণে সক্ষমতা থাকলেও ট্রেন উচ্চগতিতে চলতে পারে না। গতি কমিয়ে চলতে হয় যেন দুর্ঘটনা না হয়। এইসব ক্রসিংয়ের কারণে মাশুল দিতে হয় রেলযাত্রীদের। কেননা সব লেভেলক্রসিং যৌক্তিক নয়, বহু অযৌক্তিক চাহিদাতেও গড়ে উঠেছে লেভেল ক্রসিং। যার কারণে ট্রেনের গতি কমার পাশাপাশি বেড়েছে দুর্ঘটনাও।

দেশে মোট লেভেলক্রসিং সংখ্যা ২৬১২ টি। এর মধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত লেভেলক্রসিং হচ্ছে মাত্র ১৪১২টি৷ আর অবৈধ লেভেল ক্রসিং হচ্ছে ১২০০। এসব অবৈধ লেভেল ক্রসিং বানানোর সময় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি। নিজেদের প্রয়োজনেই যে যখন পেরেছেন ইচ্ছেমতো রাস্তার মাঝে গড়ে তুলেছেন লেভেল ক্রসিং।

এসব অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নাই, নেই কোনো সতর্কতা ব্যবস্থাও। ফলে হরহামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত পাঁচ বছরে লেভেল ক্রসিংয়ে কাটা পড়ে মারা গেছে ১২০ জন মানুষ। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরও বহু বেশি।

রেলের হিসাবে ২০১৪ সালে লেভেল ক্রসিংয়ের কাটা পড়ে মারা গেছে ৫৪ জন। ২০১৫ সালে মারা গেছে ১৩ জন। ২০১৬ সালে মারা গেছে ১৩ জন। ২০১৮ সালে মারা গেছে ১৭। আর ২০১৯ সালে মারা গেছে ২০ জন। বেশিরভাগ সময়ই এ ধরনের দুর্ঘটনার জন্য রেল অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোকেই দায়ী করে থাকে। প্রতি বছরের হিসেবে এ বছর দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এর সংখ্যা আরও বাড়বে। ১৯ ডিসেম্বর ২০২০, জয়পুরহাটে লেভেল ক্রসিংয়ে কাটা পড়ে মারা যায় ১২ জন মানুষ। তবে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব লেভেল ক্রসিংয়ের বিরুদ্ধে কখনোই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি রেল।

রেলের হিসাব মতে সারাদেশে অবৈধ লেভেল ক্রসিং সবচেয়ে বেশি বানিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তাদের লেভেল ক্রসিংয়য়ের সংখ্যা ৫১৬টি, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) এর অবৈধ লেভেল ক্রসিং ১১টি। ইউনিয়ন পরিষদের অবৈধ লেভেল ক্রসিং সংখ্যা ৩৬৩টি। পৌরসভা অবৈধ লেভেল ক্রসিং বানিয়েছে ৮০টি। সিটি করপোরেশনের অবৈধ লেভেল ক্রসিং সংখ্যা ৩৪ টি। জেলা পরিষদ অবৈধ লেভেল ক্রসিং বানিয়েছে ১৩টি। চট্টগ্রাম বন্দর অবৈধ লেভেল ক্রসিং বানিয়েছে তিনটি। বেনাপোল বন্দরেরও একটি অবৈধ ক্রসিং রয়েছে। আর সর্বশেষ যে জয়পুরহাটে ১২ জন লোক মারা গেল সেই জয়পুরহাটের চিনিকল কর্তৃপক্ষের রয়েছে তিনটি অবৈধ লেভেল ক্রসিং।

মাত্র ৩০০০ কিলোমিটার রেলপথে যদি বাড়ি বাড়ি পৌঁছানোর জন্য একটি করে লেভেল ক্রসিং হয় তবে দুর্ঘটনা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। এ লেভেল ক্রসিং শুধু দুর্ঘটনায় বাড়াচ্ছে না পুরো রেলব্যবস্থাকে ফেলছে হুমকির মুখে। অথচ কী আজব তামাশা! রেললাইন কেটে কে কখন ক্রসিং বানাচ্ছে রেলপথ মন্ত্রণালয় তা জানেই না, অনেক সময় জেনেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো যদি সত্যিই মানুষের প্রয়োজন হয়ে থাকে তাহলে সেগুলোকে বৈধতা দেয়া হোক। আর অযৌক্তিক লেভেলক্রসিংগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হোক। ট্রেনের গতি বাড়ানোর জন্য কমানো হোক লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা।

আবার বৈধ ক্রসিংয়ের ১০০০টি চলছে গেটম্যান ছাড়া। সেখানে লোকবল নিয়োগ দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হোক।

পৃথিবীর সব দেশের নিরাপত্তা গতি আর প্রযুক্তির দিকে নজর দেয়া হলেও বাংলাদেশের রেলওয়ে চলছে সেই ব্রিটিশ আমলের পুরানো পদ্ধতিতে। অবৈধগুলোকে বৈধতা দিয়ে আর লোকবল নিয়োগ দিলেই লেভেল ক্রসিংয়ে মানুষের মৃত্যু কমবে না। এজন্য দরকার আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন ক্রসিং ব্যবস্থা। অটোমেটিক সিগনালিং ব্যবস্থা। লেভেল ক্রসিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা। আধুনিক রেলব্যবস্থায় ক্রসিংয়ে তিন স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকে, অথচ আমরা পড়ে আছি এখনো মান্ধাতা আমলের সিগন্যাল পদ্ধতি নিয়েই। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ সবাই বলছেন, প্রতিদিন বলছেন। লেভেল ক্রসিং কমিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য। কিন্তু সে কাজটি যেন হয়ে উঠছে না।

প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, কমছে ট্রেনের গতি। তবুও বিশেষজ্ঞদের কোনো পরামর্শই যেন কানে ঢুকছে না রেলের। অথচ থেমে নেই উন্নয়ন প্রকল্প। গত ১০ বছরে উন্নয়নে খরচ করা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। চলছে ৩৯টি উন্নয়ন প্রকল্প, যার সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ তবুও কমছে না মৃত্যুর সংখ্যা। টাকা খরচ হচ্ছে ঠিকই তবে কেন জানি লেভেল ক্রসিং আধুনিকীকরণে মনোযোগ নেই রেলের। তবে কি এভাবেই চলবে রক্তক্ষরণের উন্নয়ন? সূত্র : ঢাকা টাইমস।